ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  গুণগত কারণেই প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ছিল - ড. আমিন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এবং  প্রাচীনতম উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় বিধানসভায় গৃহীত ‘‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯২১’’-এর অনুবলে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জুলাই ইংল্যান্ডের অক্সব্রিজ শিক্ষা ব্যবস্থার অনুসরণে এটি স্থাপিত হয়। প্রসঙ্গত, অক্সব্রিজ মানে অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ। শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে অক্সব্রিজের মিল রেখে কাঠামো ও ব্যবস্থাপনার বিন্যাস - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলার প্রথম কারণ, তবে একমাত্র কারণ নয়। প্রথম উপাচার্য পিজি হার্টগ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ষপূর্তির  সভায় বলেছিলেন,  I'm proud, I'm the first vice chancellor of Dhaka University,  the “Oxford of the East”. 

ঢাকার রমনা এলাকার প্রায় ৬০০ একর জমি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।৩টি অনুষদ (কলা, বিজ্ঞান ও আইন), ১২টি বিভাগ, ৬০ জন শিক্ষক, ৮৪৭ জন ছাত্র-ছাত্রী এবং ৩টি আবাসিক হল নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। কলা অনুষদের অধীনে ছিল ৮টি বিভাগ: সংস্কৃত ও বাংলা, ইংরেজি, শিক্ষা, ইতিহাস, আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ, ফার্সি ও উর্দু, দর্শন এবং রাজনৈতিক অর্থনীতি; বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে ছিল পদার্থবিদ্যা, রসায়ন এবং গণিত; আইন অনুষদের অধীনে ছিল শুধুমাত্র আইন বিভাগ। ৩টি অনুষদের ৮৪৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৮৬ জন ঢাকা (শহীদুল্লাহ) হলে, ৩১৩ জন জগন্নাথ হলে এবং ১৭৮ জন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ও অনাবাসিক শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হয়।

উইকিপিডিয়ার মতে,  সূচনালগ্নে বিভিন্ন প্রথিতযশা বৃত্তিধারী ও বিজ্ঞানীদের দ্বারা কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রিত হবার প্রেক্ষাপটে এটি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে স্বীকৃতি পায়। এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাপিডিয়া মতে, প্রাথমিক বছরগুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকগণ কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে শিক্ষার উচ্চমান বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিলেন, যার ফলে এ প্রতিষ্ঠান (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে।

স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। অধ্যাপক জর্জ হ্যারি ল্যাংলি, স্যার এফ রহমান, ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার, ড. ওয়াটার অ্যালেন জেঙ্কিন্স প্রমুখের মতো বিশ্বখ্যাত শিক্ষকগণও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। ড. আর.সি মজুমদার, ডব্লিউ এ জেঙ্কিন্স, ড. জি.ডি মরিসন, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, এ.এইচ.এম আব্দুল হাই, স্যার এ.এফ রহমান, প্রফেসর এফ.সি টার্নার, মহামোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, মুনীর চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, সিরাজুল হক, জি.সি দেব, জে.সি ঘোষ এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু-সহ আরও অনেকে খ্যাতিমান ব্যক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন।

দুনিয়া-কাঁপানো  বোস-আইনস্টাইন থিউরির জনক সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বসেই তিনি বোস-আইনস্টাইন তত্ত্বের জন্ম দিয়েছেন। আইনস্টাইনের মতো বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীও বাঙালি বোসের মেধায় মোহিত হয়ে পড়েছিলেন। তাই তিনিও (আইনস্টাইন) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

সূচনালগ্ন থেকে প্রায় অর্ধ শত বছর অবধি ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের  অধিকাংশ শিক্ষকের মেধা-মনন, শিক্ষাদান, শিক্ষক-শিক্ষার্থীগণের সামগ্রিক মান ও আচরণ, নিয়োগ-প্রক্রিয়া এবং মূল্যায়ন প্রভৃতি ছিল অক্সফোর্ড-ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুল্য। বরং অনেক ক্ষেত্রে তা ছিল অক্সব্রিজের চেয়েও ঋদ্ধ। তাই সারা বিশ্বে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত হয়ে পড়ে। অধিকন্তু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজ শিক্ষকগণও সবখানে  নিজেদের ‘ টিচার অব দ্যা অক্সফোর্ড অব দ্যা ইস্ট’ বলে পরিচয় দিতেন। ফলে পৃথিবীর বহু দেশের খ্যাতিমান অনেক শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের জন্য চলে আসতেন। তেমনি, আগ্রহী হয়ে উঠতেন অনেকে বিদেশিও- এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় নিয়োজিত হতে।

আমার সিনিয়র বন্ধু ধামি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর  জেনারেল পদ থেকে অবসরে গিয়েছেন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাঁর মতে, “ষাটের দশকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ডের সঙ্গে যে-কোনো বিবেচনায় পাল্লা দেওয়ার যোগ্যতা রাখত।” অতএব, কাঠামোগত কারণে নয়, বরং গুণগত সমৃদ্ধির কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিল। সেই  ঐতিহ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ধরে রাখতে পারেনি।

স্বাধীনতার পর থেকে শুধু রাজনীতিক কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য ধীরে ধীরে ধুলোয় মিশে যেতে থাকে এবং অল্প সময়ের মধ্যে তা পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়, ঢেকে যায় সব সাফল্য ব্যর্থতার কালো মেঘের আড়ালে। আসলে যেদিন থেকে, উপাচার্য নিয়োগে মেধার চেয়ে রাজনীতি বা আনুগত্য কিংবা তোষণ মুখ্য হয়ে উঠে, সেদিন হতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পতন শুরু হয়।  এশিয়ার একশটি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দেখা যায় না। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বলতে ভেসে উঠে- হানাহানি, কোন্দল, ক্ষমতা আর প্রভাবের কাছে মেধার বারংবার অসহায়ের মতো পাণ্ডুর-পাংশু পরাজয়  এবং নীতি-নৈতিকতার চরম আর্তনাদ।

Comments

Popular posts from this blog

ডিসি বা ডেপুটি কমিশনার কেন জেলা প্রশাসক - ড. আমিন

মূর্তি ও ভাস্কর্য - ডঃ আমিন

আইনস্টাইনের পাঁচ বাড়ির ধাঁধা: মৎস্যাধারের মাছ চুরি করেছে কে?