বাঙালি' এবং পশ্চিম বাংলার নির্বাচন - ফরহাদ মজহার

১.

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে। আমরা যারা তরুণ তখন লেখালিখি করতাম  স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের অনেকেরই এই কাণ্ডজ্ঞানটুকু জন্মেছিল যে বাংলাদেশকে যদি কদম বাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয় তাহলে কলকাতার দিকে তাকালে চলবে না। হুমায়ূন আহমেদ সেটা ভাষা ও সাহিত্যের জায়গা থেকে বুঝতো, কলকাতার ভাষায় গদ্য লেখা যাবে না, গল্পকে গল্পের মতো সহজ সরল গদ্যে বলবার ধারা তৈরি করতে হবে, যেন ক্লাস এইটের কিশোরও পড়ে আনন্দ পায়, বাংলাভাষাকে যেন তার বিদেশি ভাষা মনে না হয়। সংস্কৃত ও তৎসম শব্দের জুলুম ও আকীর্ণতা থেকে ভাষাকে সকলের কাছে গল্প বলবার মাধ্যমে পরিণত করা যায়।

আহমদ ছফা আরও সামগ্রিক ভাবে বুঝতো যে বাংলাদেশকে কলকাতার আর কিছুই দেবার নাই। বাংলাদেশের মতো একটি সদ্য স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠির অন্তর ও বাহিরের চাহিদা মেটাবার সামর্থ বাস্তব কারণেই পশ্চিম বাংলার থাকতে পারে না। উপমহাদেশ যদি দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে থাকে তাহলে ভারত সেকুলারিজমের পোশাক পরা একটি হিন্দু রাষ্ট্রই কেবল। বাংলাদেশের বিকাশ ও জাতীর নিরাপত্তার জন্য হুমকি। পশ্চিম বাংলা হিন্দু ভারতের অধীনস্থ একটি হিন্দু রাজ্য মাত্র। ফলে ভাষা বা সংস্কৃতির জায়গায় দাঁড়িয়ে বাঙালি হবার সাধনা না করে তারা  হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও হিন্দু রাষ্ট্রকেই শিরোধার্য গণ্য করবে, এতে অবাক হবারকিছু নাই।

পাকিস্তান আমলে ঢাকা-কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর হঠাৎ অনেকে আসাযাওয়া শুরু করলেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে আমরা স্পষ্ট বুঝেছিলাম বাংলাদেশের জনগণের জীবন এবং তাদের ইতিহাস সম্পর্কে পশ্চিম বাংলার বিশেষ কোন আগ্রহ নাই। আমরা বাঙালি, পাকিস্তান ভেঙে দিয়েছি, এতে তারা দারুন উৎফুল্ল ছিলেন। যদ্দূর মনে পড়ে নব্বইয়ের শেষের দিকে আহমদ ছফা কলকাতার একটি পত্রিকার সাক্ষাৎকারে একাত্তরে আমাদের উপলব্ধির কথা স্পষ্টই বলেছিলেন, কলকাতার দিকে আমরা আর তাকিয়ে থাকব না।

কিন্তু একাত্তরের আগে কি তাকিয়ে থাকতাম? হ্যাঁ থাকতাম। কারন বাঙালি হিশাবে নিজেকে চিনবার ও বুঝবার জরুরি উপাদান ও প্রেরণা আমরা কলকাতার কাছ থেকেই পেয়েছি। সাবেক পাকিস্তানে আমাদের বাঙালি হবার প্রণোদনা কলকাতা জুটিয়েছে। আমাদের ভাষা ও সাংস্কৃতিক সত্তার উপলব্ধি সঞ্চারিত করবার ক্ষেত্রে কলকাতার নির্ধারক ভূমিকা আছে। শুধু শরণার্থি হিশাবে আমরা পশ্চিম বাংলার জনগণের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব তা নয়, বাঙালি হিশাবে কলকাতার তৈরি আয়নায় নিজের মুখ দেখে আমরা বাঙালি হবার সাহস অর্জন করেছি। হোক সেটা  উচ্চ বর্ণের হিন্দুর তৈরি আয়না, কিন্তু আমরা গ্রাহ্য করি নি। কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার পরপরই কলকাতা থেকে আসা যেসব শিল্পীসাহিত্যিকদের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা হয়েছে  তাতেই আমরা বুঝে গিয়েছিলাম কলোনিয়াল আমলে গড়ে ওঠা জাতিবাদী হিন্দুর খাসিলত পশ্চিম বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও সাহিত্যিক মহল কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা।

হিন্দু রাষ্ট্র ভারতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপির শক্তি বাড়ছে, অতএব এতে অবাক হবার কিছু নাই। পার্থ চ্যাটার্জির ভাষায় বলতে পারি এটা হচ্ছে ‘ইতিহাসের উত্তরাধিকার’ হিন্দু বাঙালি ইতিহাসকে যেভাবে কল্পনা করেছে এবং করে, এখনকার পশ্চিম বাংলা তার ব্যতিক্রম কিছু করছে না। পার্থ চ্যাটার্জি স্বীকার করেছেন, ‘বিকল্প ইতিহাস রচনার জন্য প্রস্তুতি এখনও পর্যন্ত আমাদের নেই’   পশ্চিম বাংলা এক সময় পুরা ভারত নিয়ে ভাববার সামর্থ রাখতো। অখণ্ড ভারত খণ্ডিত হয়েছে বটে, কিন্তু নিদেন পক্ষে সাতচল্লিশের পর পুরা দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে সামগ্রিক ভাবে ভাববার সামর্থ কলকাতার অর্জন করার আশা  অপ্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু কংগ্রেস, সিপিএম কিম্বা মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল হয়ে এখন হিন্দুত্ববাদের যে চেহারা আমরা বাংলাদেশ থেকে দেখছি তাতে স্পষ্ট সীমান্তের দুই দিকেই ইতিহাস অনেক রক্তপাত, হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাস ঘটাতে বদ্ধ পরিকর হয়ে উঠছে।

সাম্প্রতিক নির্বাচনে বিজেপি জিততে যাচ্ছে তার আভাস দিচ্ছেন অনেকে। খবরে দেখছি সিপিএম রাজনীতি করতেন এমন বামেরা বিজেপিতে যোগদান করছেন। এতে অবাক হবার কিছু নাই। আসলেই যদি বিশ্বাস করি যে তথাকথিত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়েছে, তাহলে মানতেই হবে ভারত সেকুলারিজম ও গণতন্ত্র দিয়ে নিজের লুকিয়ে রাখা হিন্দু রাষ্ট্রের রূপই দেখাবে। এই পরিস্থিতিতে কলকাতার কাছে কোন নতুন উপাদান বা প্রেরণা দুরাশা তো বটেই, বরং হিন্দুত্ববাদের শক্তিবৃদ্ধির পরিণতি বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে কী হতে পারে তা নিয়ে আমাদের আতংকিত হতে হচ্ছে।

সীমান্তের এদিকে ফুটতে থাকবে হিন্দুত্ববাদ বা জাতিবাদী হিন্দুর বিপরীতে জাতিবাদী মুসলমানদের রূপ। জাতিবাদী মুসলমান নিজেকে আরব, ইরানি বা তুরানি ভাবে; অথচ বাংলা আমামদের ভাষা, বাঙালি মুসলমানেরই ভাষা, বাংলা তার সংস্কৃতি। বঙ্গে তো বটেই, ভারতবর্ষে ইসলামের  নিজস্ব ইতিহাস আছে। কিন্তু জাতিবাদী মুসলমান সেই ইতিহাস জেনে এখনকার বাস্তব চ্যালেঞ্জ মীমাংসায় আগ্রহী না। সে চ্যালেঞ্জ এড়িয়ে যেতে চায়। নিজের গৌরবকেও অস্বীকার করে। সুলতানি আমলের বৃহৎ বাংলার স্মৃতি সে ভুলে গিয়েছে। অতএব ইসলামের সঙ্গে স্থানীয়তা ও লোকায়তিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটাবার কর্তব্য থুয়ে ধর্মকে সে স্রেফ আত্মপরিচয়ের হাতিয়ার ভাবে। হিন্দু বা বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জিহাদকেই সে পরম পূন্য জ্ঞান করে। চ্যালেঞ্জ মীমাংসা করে  বাঙালি হিন্দুকে বৃহত্তর বাঙালির অন্তর্গত করে নেওয়ার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সে ধরতে পারে না। এই অজ্ঞানতা যতোই গাঢ় হবে বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি হিন্দু আর পরস্পরকে চিনতে পারবে না।

হিন্দু বাঙালি মুসলমানের গড়ে ওঠার ইতিহাস জানে না। এতোকাল তারা গীতা, মহাভারত উপনিষদে ডুবে ছিল, তাদের আত্মপরিচয় তারা তাদের ধর্মীয় কেতাবে ঢুঁড়েছে। কিন্তু ব্যাখ্যাটা তাদের নিজেদের না। ঋষি আর তপোবনের হিন্দুত্বের জগত ওরিয়ান্টিলস্টদের তৈয়ারি জিনিস। সনাতন ধর্মের বিচিত্র্, বিভিন্ন এবং পরস্পর বিরোধী সমৃদ্ধ ধারা সম্পর্কে তার বিশেষ জ্ঞান নাই। হিন্দু যে একাট্টা কেতাবি ধর্ম না, এটা অধিকাংশ হিন্দু জানে কিনা সন্দেহ। খ্রিস্টান আর মুসলমানদের মতো তারাও বিশ্বাস করতে শিখেছে যে রামায়ন মহাভারত গীতা উপনিষদ ভগবানের তরফে আসমান থেকে তাদের প্রতি নাজেল হয়েছে। 

ইংরেজের তাঁবেদারি আর পূর্ব বাংলায় জমিদারি করে বাঙালি হিন্দু জমিদার, মহাজন ও বেনিয়ারা কলকাতার বাবু সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। এখন বাঙালি মুসলমান যখন স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জ মীমাংসার  জন্য  ইসলাম নিয়ে, ইসলামের ইতিহাস নিয়ে, বাঙালি মুসলমানের স্বার্থ নিয়ে কিম্বা কোরান হাদিস নিয়ে দুই এক কথা বলতে চায়, বাঙালি হিন্দু তার গুরুত্ব বুঝতে পারে না। তাদের চোখে সবাই মৌলবাদী। তারা নিরন্তর  জিহাদের আতংকে ভোগে।

আমি সব সময়ই বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের পারস্পরিক বোঝাবুঝির জায়গা তৈরি করার ওপর ‘বাঙালি’ হিশাবে উভয়ের ভবিষ্যৎ নিহিত রয়েছে বলে দাবি করি। যদি আদৌ তেমন কিছু থাকে। না, পরস্পরের পিঠ চাপড়িয়ে দেওয়া না। পরস্পরকে বোঝা।  একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরও বাঙালি হিন্দু কিম্বা বাঙালি মুসলমানের মধ্যে গভীর কোন বোঝাবুঝি বা সম্বন্ধ  গড়ে ওঠে নি। এটা বিস্ময়কর। এতে আমরা কী বুঝি?  ‘বাঙালি’ নামক কোর্তা পরিয়ে হিন্দুকে যেমন বাঙালি বানানো যায় না, কোর্তার নীচে সে নরেন্দ্র মোদির হিন্দুই থেকে যায়, তেমনি মু্সলমানকেও সেকুলার বাঙালির পোষাক পরালে সে মুসলমানই থাকে। কারণ ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির চ্যালেঞ্জ মীমাংসায় দুইয়ের কারুরই এখন অবধি  আগ্রহ নাই।

'বাঙালি' নামক কিছু আসলে বাস্তবে নাই।  বাঙালি আগামিতে হয়ে ওঠার ব্যাপার। একটা স্বপ্ন, একটা প্রকল্প, যা আমরা একাত্তরে দেখেছিলাম। তার বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব কিনা জানি না। কিন্তু পশ্চিম বাংলায় হিন্দুত্ববাদের শক্তি বৃদ্ধি দেখে মনে হচ্ছে হিন্দুত্ববাদ বাঙালির কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দিতে চাইছে।

২.

তৃণমূল, কিন্তু বিশেষ করে মমতা ব্যানার্জির বিরুদ্ধে নির্বাচন কেন্দ্র করে প্রধান অভিযোগ হচ্ছে তিনি মুসলিম তোষণ করেছেন, এরই প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিম বাংলায় বিজেপির উত্থানের শর্ত তৈরি হয়েছে। এই অভিযোগ সিপিএমের বিরুদ্ধেও আমরা আগে শুনেছি। এমনকি কংগ্রেসের বিরুদ্ধেও।  বিজেপির উত্থানের দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে মুসলমান আতংক,সেটা হোল মুসলমান জনসংখ্যা বেড়ে যাবার ভীতি। এই ক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জির কোন হাত আছে কিনা জানি না, কিন্তু অনেকের মন্তব্য ও লেখালিখি পড়ে মনে হয় মুসলমান পরিবারে সন্তান জন্ম নেবার অপরাধও যেন মমতা ব্যানার্জির! কারণ তাদের অভিযোগ তৃণমূল আমলে মুসলমান সংখ্যার ভীতি হিন্দু ভোটারদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে, তাই তারা বিজেপির দিকে ঝুঁকেছে।

তাহলে মুসলমান তোষণের গল্পে পরে আসি। এখন সংখ্যাভীতি। কারন মুসলমান জনসংখ্যার তর্ক এবং সংখ্যাভীতি এখনকার নয়, পুরানা। পুরানা কেচ্ছা একটু বলি।

আরে, উচ্চবর্ণ ও অভিজাত হিন্দু তো বাংলা ভাগ করলো মুসলমান জনসংখ্যার ভয়ে।উনিশ শো পাঁচ সালে প্রশাসনিক কাজ সহজ করবার যুক্তি দিয়ে কার্জন বাংলা ভাগ করেছিলেন। উচ্চ বর্ণ এবং অভিজাত হিন্দু তার ঘোর প্রতিবাদ জানালেন।ভাল। ঐ সময়েই বঙ্গে অখণ্ড ভারতের কল্পনা এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রোপিত হোল:ভারত ভাগ করা যাবে না, অখণ্ড রাখতে হবে। বাংলা ভাগের মধ্যে বাঙালি হিন্দুর মনে ভারত ভাগের ভীতি তৈরি হয়েছিল। কারন ততোদিনে বঙ্গে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের শক্তিশালী ধারা তৈরি হয়েছে, যার গোড়ায় রয়েছে হিন্দু জাতীয়তাবাদ। বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮-১৮৯৪), স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২),অরবিন্দ ঘোষ ১৮৭২ - ১৯৫০)  প্রমুখের রচনার তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ ভূরি ভূরি মজুদ রয়েছে। মুসলমান দেখেছে উচ্চ বর্ণের হিন্দু ও অভিজাত শ্রেণি কিভাবে ‘বাঙালি’ ধারণার পরিগঠন থেকে বাঙলা প্রদেশের অর্ধেক বাঙালি জনসংখ্যাকেই নির্বিচারে বাদ দিচ্ছে। মুখে যাই বলুক, বাঙালি মুসলমান আজ অবধি হিন্দুর চোখে ‘বাঙালি’ না। মুসলমান।

সেই সময় পশ্চিমবাংলা ছিল হিন্দু প্রধান ভূগোল, মুসলমানরা সেখানে সংখ্যালঘু, অন্যদিকে পূর্ববাংলায় মুসলমানদের সংখ্যা ছিল বেশি, অখণ্ড বাংলায় মুসলমান কিন্তু সংখ্যালঘু ছিল না, বরং সামান্য হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠই ছিল। কিন্তু শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অগ্রগামী ও আধিপত্য ছিল বর্ণ হিন্দু এবং আর্থসামাজিক দিক থেকে পূর্ব বাংলার জমিদারি মহাজনি টাকায় গড়ে ওঠা কলকাতার অভিজাত বাবু মহল বা সামাজিক-রাজনৈতিক ভাবে শক্তিশালী হিন্দু শ্রেণির। পূর্ববাংলার মানুষ বঙ্গভঙ্গের প্রতি জোরালো সমর্থন জানিয়েছিল, কারণ তাদের উপলব্ধি ছিল ভিন্ন, তারা আশা করেছিল, ক্ষতাবান হিন্দু যখন তাকে বাঙালি বলেই মানে না, বাংলা ভাগ হলে তারা তাদের নিজস্ব একটি প্রদেশ পাবে। প্রশাসনিক স্বাধীনতা পাওয়া, নিজেদের রাষ্ট্র গঠনের সুপ্ত তাগিদ থেকে জাত। পরে পাকিস্তান  যখন প্রাদেশীক স্বায়ত্ব শাসন মানল না, উর্দু চাপিয়ে দিতে চাইল, বাঙালি অস্ত্র ধরতে দ্বিধা করে নি। স্বাধীনতার বাসনা হঠাৎ একদিন হুজুগে তৈরি হয় নি।

সংখ্যার তর্ক, দেখা যাচ্ছে, বিচ্ছিন্ন কোন তর্ক না। একই সঙ্গে ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আত্মপরিচয়, জাতিবাদ ইত্যাদি তর্কের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত। অতএব সংখ্যার তর্ককে ইতিহাস থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন ভাবে তোলা পদ্ধতি হিশাবে ভুল। সংখ্যার হিশাব নিকাশ ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া রাজনীতির জন্য নির্ধারক ধারণাগুলোর পরিগঠন থেকে আলাদা নয়। সেই ধারণাগুলো তৈরি হয় ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে, বয়ান তৈরির ভাঙা গড়ার মধ্যে। জাতি, জাতিরাষ্ট্র ইত্যাদির ধারণা তৈরির ক্ষেত্রে বয়ানের ভূমিকা নির্ধারক। অতএব হিন্দু মুসলমানের সংখ্যা নিয়ে তর্ককে আমরা জাতিবাদ এবং আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিকাশ থেকে একদমই আলাদা করতে পারি না। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সেই সম্ভাব্য রাষ্ট্রের ভ্রূণ তৈরি হয়েছিল ঔপনিবেশিক পরিমণ্ডলে। কিন্তু সেটা ঘটেছিল বিভেদের পাটাতনে দাঁড়িয়ে, ঐক্যের না।

উচ্চবর্ণ এবং অভিজাত হিন্দুগণ ‘বাঙালি’ নামে যে ধারণা প্রতিষ্ঠিত করবার প্রকল্প নিয়েছে এবং সফল হয়েছে  সেখানে বাঙালি মুসলমান অনুপস্থিত। একমাত্র হিন্দুই বাঙালি। ‘মুসলমান’ আলাদা জাতি। বাংলা প্রদেশে মুসলমান কিছুটা সংখ্যগরিষ্ঠ হলেও অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার দিক থেকে বর্ণ হিন্দু ও অভিজাত হিন্দু শক্তিশালী। ফলে তারা মনে করেছিল বাংলা ভাগ তাদের স্বার্থের অনুকুল নয়। তাই তারা বঙ্গভঙ্গ বা বাংলা বিভক্তির বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়। বর্ণ হিন্দু ও অভিজাত শ্রেণি অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন দেখতে গিয়ে তাদের সাহিত্য ও বাঙালি পরিচয় নির্মাণে যে সাম্প্রদায়িক ভেদ তৈরি করেছে তারই পরিণতিতে জাতিবাদী হিন্দু এবং জাতিবাদী মুসলমানের আবির্ভাব নিশ্চিত হয়েছে। পরিণতি প্রতিবাদ, বিক্ষোভ এবং সহিংসতা। ফলে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়।

কিন্তু ১৯৪৭ সালে বাংলা যখন আবার ভাগ হোল হিন্দু তা সক্রিয় ভাবে সমর্থন করল। কেন? এবারও সংখ্যার ভয়। ১৯৩৩ সালে রামজে ম্যাকডোনাল্ডের ‘সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ’ মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ও ইউরোপীয়দের জন্য পৃথক নির্বাচনের প্রস্তাব করে সংখ্যার রাজনীতিকে মুখ্য করে তোলেন, মহাত্মা গান্ধী এর প্রতিবাদে অনশন করেন কিন্তু বি আর অম্বেদকার এ রোয়েদাদ সমর্থন করেন। ফলে ভোটার হিশাবে হিন্দু মুসলমানের রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্য আমূল বদলে যায়। হিন্দু সমাজ একে মেনে নেয় নি। মুসলমান জনসংখ্যার ভীতি হিন্দুর মনে স্থায়ী ভাবে গেঁড়ে বসবার ঐতিহাসিক শর্ত তৈরি হয়।

সংখ্যার ভীতি প্রতিনিধিত্বমূলক সংখ্যা ভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে। গণতন্ত্রকে যখন একই সমাজের অপরকে জায়গা করে দেওয়া, অপরের অধিকার  এবং সমাজের বৈচিত্র ও বিভিন্নতা স্বীকার এবং সকলকে ‘নাগরিক’ হিশাবে অধিকার ও দায় তৈরির উপায় গণ্য না করে  স্রেফ নির্বাচনী ব্যবস্থায় পর্যবসিত করা হয়, তখন রাজনীতিতে একমাত্র সংখ্যাই মুখ্য বিষয়ে পরিণত হয়। সংখ্যাই ক্ষমতা লাভের উপার হয়ে ওঠে। দেখা যাচ্ছে গণতন্ত্রের সুনির্দিষ্ট রূপের পর্যালোচনা না করে সংখ্যার আলোচনা অর্থহীন।

মুসলমান জনসংখ্যা বেড়ে যাবার ভীতি পুরানা জিনিস, এর জন্য পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির শক্তি বেড়েছে,এই অভিযোগের কোন ভিত্তি নাই। পশ্চিম বাংলার বাঙালিগণ 'বাঙালি' ধারণার মধ্যে মুসলমান অনুপস্থিত এর রাজনৈতিক পরিণতি সম্পর্কে অজ্ঞ। একে মোকাবিলার কোন চেষ্টা পশ্চিম বাংলায় ক্ষীণ। যাঁরা করতে চেয়েছেন তাদের রাজনৈতিক প্রভাব নাই বললেই চলে। পশ্চিমবাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদ সবসময়ই হিন্দু জাতীয়তাবাদের অধিক কিছু ছিল না। সেটা যতোই স্পষ্ট হচ্ছে, হিন্দুত্ববাদের রাজনৈতিক চর্চার ক্ষেত্র যতোই বাড়ছে,  জাতিবাদী হিন্দু ততোই মুসলমান সংখ্যার কথা ভেবে আতংকিত হচ্ছে।

আমি যেহেতু বাঙালি, ভাষার মধ্যেই আমি বাঁচি, তাই রাজনৈতিক-দার্শনিক কারণে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আমার পক্ষপাত রয়েছে। এই ভেদ ও বিভাজন যদি ঐতিহাসিক হয়, তাহলে ঐতিহাসিক ভাবেই তা অতিক্রম করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। প্রাথমিক কাজটা শিল্পী সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক কর্মীদের ঘাড়েই পড়ে। কিন্তু সেটা অন্নদাশংকর রায়ের আবেগ দিয়ে হবে কিনা সন্দেহ, কারন পাশাপাশি দরকার ঔপনিবেবেশিক শাসন ও উত্তর-ঔপনিবেশিক রাজনীতি ও রাষ্ট্র গঠনের পর্যালোচনা। নিদেন পক্ষে মমতা ব্যানার্জিকে এই ক্ষেত্রে খামাখা দোষারোপ না করে নির্বাচনী রাজনীতি ও সংখ্যাভীতির ঐতিহাসিক কারণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা তৈরি।

যদি আমরা আদৌ বাঙালির ঐতিহাসিক ভুল কাটিয়ে তুলতে চাই তাহলে অসুখকে ঠিক জায়গাতেই শনাক্ত করতে জানতে হবে।

৩.

আগের আলোচনায় দেখিয়েছি সংখ্যাভীতি পশ্চিম বাংলায় নতুন কিছু না, হিন্দুত্ববাদি রাজনীতি সবসময়ই সংখ্যাভীতিকে কাজে লাগিয়েছে। আসলে শুধু পশ্চিম বাংলা নয়, এটা সর্ব ভারতীয় বাস্তবতা। সম্প্রতি কালে দুই হাজার এগারো সালের লোকগণনার ফল বেরুনোর পর থেকেই সংখ্যাভীতি সর্ব ভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুই হাজার এগারোর লোকগণনার তথ্য জানিয়ে সে সময় একটি বিবৃতি দেয়, তাতে বলা হয়, “পুরা জনসংখ্যার বিচারে হিন্দু জনসংখ্যা শতকরা ০.৭ পয়েন্ট কমেছে।  আর মুসলমান জনসংখ্যা বেড়েছে শতকরা ০.৮ পয়েন্ট’। লোকগণনার তথ্য হিন্দুত্ববাদিদের হাতে ভাল অস্ত্র হয়েছে। যারা সংখ্যা নিয়ে ভাবতে পছন্দ করেন তাদের জন্য নীচে একটি পরিসংখ্যান গ্রাফ টুকে দিচ্ছি। ভাবতে থাকুন।

সংখ্যাভীতি সমাজ ও রাষ্ট্র সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তর্ককে আড়াল করে এবং সমস্যাসংকুল করে ফেলে। সংখ্যাভীতি আদর্শিক তর্ক নয়, ভয় বা আতংককে নীতি নৈতিকতার বিধান দিয়ে প্রশমন করা যায় কিনা সন্দেহ। পরস্পরকে জানা বোঝার অভাব, অজানাকে ভয়, নিরাপত্তাবোধের অভাব, ক্ষমতার ক্ষয় বা লোপের আশংকা, ইত্যাদি নানান কিছু থেকে এই ভীতির জন্ম। ফলে সমাধান অন্যত্র। হিন্দু কেন মুসলমানকে নিরাপদ গণ্য করে না, কিম্বা মুসলমান হিন্দুকে? একে কি ধর্ম দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব? এটা একটা মানসিক, সাংস্কৃতিক এবং সমাজে কিভাবে আমরা বর্তমান থাকি সেই অবস্থার সঙ্গে যুক্ত। একই ভাবে আমাদের এই থাকা ধর্ম সম্পর্কে ধারণা এবং ধর্মজাত কর্মকাণ্ডকেও নিয়ন্ত্রণ করে। নিছক বুদ্ধিবৃত্তিক বিচার দ্বারা সবকিছুর মীমাংসা করা যায় না। হয়তো আমাদের মতো দেশে ভক্তি আন্দোলনের আবির্ভাব ও চর্চা এই অমীমাংসার উপলব্ধি থেকে গড়ে উঠেছে। নতুন রাজনৈতিক চর্চার জন্য নিজের দিকে নিষ্ঠার সঙ্গে মুখ ফেরানো জরুরি। গভীর ভাবে ভেবে দেখার বিষয়। বিশেষত পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা সমাজকে যখন নিরন্তর ভাঙ্গতে থাকে, তখন এর সমাধানও যখন ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে।

ভারত কি আদৌ ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র?—এই প্রশ্ন তুলেও লাভ নাই।  ভারতীয় চিন্তক আশীষ নন্দীকে জিজ্ঞাসা করলে বলতেন আমি তো দীর্ঘদিন ধরেই ধর্ম নিরপেক্ষতাকে সন্দেহ করি, গুজরাটের দাঙ্গার পর খুবই পরিষ্কার ভারতে ধর্ম নিরপেক্ষতা ব্যর্থ। কিন্তু একথা বলে কি সমস্যার সমাধান হয়? হয় না। আম্বেদকারসহ ভারতের সংবিধান প্রণেতারা সংবিধানে স্পষ্ট করে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলা দরকার মনে করেন নি। তাঁরা ভেবেছিলেন সংবিধানের বলবৎযোগ্য অনুচ্ছেদগুলোর মধ্যে ধর্ম নিরপেক্ষতা অন্তর্নিহিত হয়েই আছে, তাকে লিখিত করে রাখা অর্থহীন। ইন্দিরা গান্ধী সেটা ঢুকিয়েছেন জরুরি অবস্থা জারির পরে ১৯৭৬ সালে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং পার্লামেন্টের একটি বক্তৃতায় দাবি করেছেন, আম্বেদকার এটা করেছে কারণ তিনি জানতেন হিন্দু ধর্ম আসলে সেকুলার, ফলে আলাদা করে সেকুলারিজমের কথা সংবিধানে লিখবার তিনি কোন প্রয়োজন বোধ করেন নি।

সেকুলারিজম নিয়ে ভারতের সাংবিধানিক তর্ক অমীমাংসিত। একসময় যা মীমাংসিত মনে হয়েছিল, বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রমাণ করছে সেটা আদৌ কোন সমাধান ছিল না।

৪.

চার:  'বাঙালি' এবং পশ্চিম বাংলার নির্বাচন
......................................................
অবশেষে ভারতে নির্বাচনের ফলাফল বেরুতে শুরু করেছে। বিজেপি জিতেছে। মোদী ক্ষমতায় রইলেন। যারা আমার লেখা অনুসরণ করেছেন তাদের কাছে এটা অবাক হবার মতো কোন খবর না। মমতা ব্যানার্জি রাজ্যের ৪২টি আসনে জয়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন, দেখা যাচ্ছে ২৩টির মতো আসনে তিনি জিততে যাচ্ছেন । বোঝ যাচ্ছে মুসলমান ভোটের সংখ্যার নিজের ঝুলিতে ভরাবার জন্য মুসলমান তোষণের ফল শেষাবধি ভাল হয় নি। ভাল হয় নি কারো সঙ্গে জোট না করবার অহংকারও। তাঁর হার হোল। বামদের হেরে যাওয়া নিয়ে যতো না আক্ষেপ, তার চেয়ে তৃণমূলকে ঠেকাতে বামদের বিজেপি সমর্থন প্রবল নিন্দার কারণ হয়েছে। ‘রামবাম’ নামে বাংলা ভাষায় একটি নতুন বাগধারার সংযোজন ঘটেছে। ভালই। 

নির্বাচনে সংখ্যার রাজনীতি নিয়ে যে কথা বলছি যদি সেটা আমরা মনে রাখি, তাহলে নির্বাচনবাদী পার্লামেন্টারি রাজনীতির পর্যালোচনা বাদ দিয়ে, শুধু মতাদর্শিক মানদণ্ড দ্বারা বামের সমালোচনা আসলে অর্থহীন। বাম ভেবেছে ভোট দিয়ে মমতাকে সরানোই এখন মহান বিপ্লবী কাজ। এটা সংখ্যার রাজনীতি, মতাদর্শিক লড়াই না। ভোটের জন্য তোষণ কিম্বা ধর্মীয় আবেগের ব্যবহার পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে থাকবেই। তাই নির্বাচনের ফলাফল দিয়ে পশ্চিম বাংলা কিম্বা ভারতের বাস্তবতা বোঝা যাবে না। তারপরও বামের এই ঘোর দুর্যোগের মধ্যে আমি সাহসের সঙ্গে বলি, ‘বাম’ শেষ হয়ে যাচ্ছে বা যাবে, আমি তা মনে করি না। কোন্‌ অর্থে? ভারতে জাতপাত, শ্রেণি, সাম্প্রদায়িকতা, নারীর প্রতি হিংসা এখনও গেঁড়ে বসে আছে। তার বিরুদ্ধে লড়াই কি থামবে? অসম্ভব, এটা ফালতু কথা। ভিন্ন রূপে বা মোড়কে তা চলবে। এই অর্থেই বলা, সিপিএম আবার ভোটাভুটির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসবে সেটা আশা করে বলা নয়।

তবে যে আবর্জনা শেষ হয়ে যাবে, যাচ্ছে এবং যেতে বাধ্য, সেটা হোল নির্বিচার জাতিবাদী এবং নির্বাচন সর্বস্ব বাম ধারা। বলা হোত, জাতীয় বুর্জোয়ার  কাজ নিপীড়িত জাতি সত্তার গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করা এবং অর্থনৈতিক রূপান্তরের প্রতিবন্ধক প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক প্রাচীন সম্পর্ক বিনাশ। আসল কাজ বাদ দিয়ে বাংলাদেশে ও পশ্চিমবঙ্গে বামকুল যত্র তত্র খালি ধর্মের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছে। তারই অনিবার্য প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ধর্ম ভিত্তিক জাতিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা এবং প্রতিশোধ নেওয়া। এই শাস্তি বরাদ্দ ছিল।

মতাদর্শিক জায়গা থেকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ জন্ম থেকে আগাগোড়াই ছিল মূলত হিন্দুত্ববাদ। এটা নতুন কোন খবর বা তত্ত্ব নয়। অনেকেই এ কথা আগে বলেছেন। পার্থক্য হচ্ছে আগে জাতীয়তাবাদ দিয়ে হিন্দুত্ববাদ আড়াল করা হোত। এখন হিন্দুত্ববাদীরা প্রমাণ করলেন জোব্বা পরে আড়াল আবডালের কোন  দরকার নাই। ভারত হিন্দুদের দেশ, অতএব হিন্দত্ববাদই ছহি রাজনৈতিক আদর্শ। ভারতকে এম্পপায়ার বানাবার সুপ্ত হিন্দু বাসনা জাগিয়ে তোলাই এখনকার কাজ। অথচ এই কাজ করতে গিয়ে যে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও হিংসা তৈরি হোল তার পরিণতি ভয়ংকর হতে পারে। ভারত নিজের পায়েই নিজে কুড়াল মারছে।

হিন্দু জাতিবাদের জন্ম পাকিস্তানিদের মতো একই দ্বিজাতিতত্ত্বে, আধুনিক জাতীয়তাবাদের গর্ভে। জাতিবাদের জন্য বেনেডিক্ট এন্ডারসনের ভাষায় একটা স্বপ্ন বা কল্পিত জনগোষ্ঠির (Imagined Community) কেচ্ছা লাগে। যেন জাতপাত, শ্রেণি, লিঙ্গ, ভাষা ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য আড়াল, অস্পষ্ট বা তার নিরাকরণ ঘটিয়ে দাবি করা যায় আমরা সকলেই 'হিন্দু'। জাতিবাদী মুসলমানের দাবিও একই, আমরা সবাই 'মুসলমান'। যেন মুসলমানের সঙ্গে মুসলমানের গোত্র, গোষ্ঠি, ভূগোল, ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতি, জাতপাত, শ্রেণী ও লিঙ্গ ভেদ নাই। সবাই মুসলমান। বিশেষত যেন আরবের ইতিহাসই সকল মুসলমানের ইতিহাস, স্থানীয় কোন ইতিহাস নাই, ভূগোল নাই, শেকড় নাই।

খেয়াল করুন, যখন দাবি করা হয় ’আমরা সবাই বাঙালি’, তখনও বাঙালি জাতিবাদ সেই একই গীতই গায়। বাঙালি জাতিবাদও বাঙালির মধ্যে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং অপরাপর আর্থসামাজিক ও লিঙ্গভেদের নিরাকরণ ঘটিয়ে একটি হোমজিনিয়াস জাতিগোষ্ঠির কাহিনী বানায়। জাতিবাদের এটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য, এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত বাণিজ্য ও পুঁজির বিকাশ এবং বিস্তার, তদুপরি সবার বোধগম্য একটি প্রচলিত বা প্রমিত ভাষা গড়ে ওঠা বা বানাতে পারা এবং তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। আধুনিক ছাপাখানা এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। 

হিন্দুত্ববাদের‘কল্পিত কাহিনী’ হচ্ছে, (ক) ইংরেজের সাম্রাজ্যবাদী মানচিত্র তৈরির আগে থেকে, এমনকি মুঘলদের ‘হিন্দুস্তান’ কায়েমেরও আগে থেকেই ‘ভারত’ বা ‘ইন্ডিয়া’ নামক চিরায়ত ভূগোল বা সত্য বিরাজিত ছিল এবং চিরকাল থাকবে,; (খ) ভারত হচ্ছে তপস্বী ও ঋষিদের দেশ, সর্বত্র ছিল তপোবন এবং সাধুসন্যাসী ও রাজর্ষিদের কারবার (গ) কিন্তু সব কিছু নষ্ট হবার মূলে হচ্ছে মুসলমান আক্রমণ ও ইসলাম। মুসলমানদের পরাধীনতা ৫০০ বছর হিন্দুকে সহ্য করতে হয়েছে (ঘ) আর্য হামলা ও দখল কিম্বা ইংরেজের ঔপনিবেশিক শাসন কোন সমস্যা নয়, হিন্দু আত্মপরিচয় ও জাগরণের প্রধান বাধা বা দুষমণ হচ্ছে মুসলমান ও ইসলাম। অতএব মুঘল ও ইংরেজ শাসন মিলিয়ে সাতশ বছর পরাধীন থাকা হিন্দুর জাগরণ তো ন্যায্য এবং স্বাভাবিক (গিরিলাল জৈন পড়ুন)। সিন্ধু নদীর এপাশে বাস করা জনগণের মধ্যে ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, জীবন যাপন, খাদ্যাভাস, চাষাবাদ, লোকগল্প বা পুরাণ ইত্যাদির পার্থক্য বিশাল। হিন্দু জাতিবাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সেইসব পার্থক্য চেপে রেখে সুনির্দিষ্ট ভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের বিপরীতে ‘হিন্দু’ নামক ধারণার সংজ্ঞায়ন। বাস্তবে যার কোন অস্তিত্ব নাই। কারন হিন্দু কোন ধর্ম না এবং হিন্দু কোন জাতিও না। সিন্ধু নদীর উচ্চারণ বিভ্রাটের ফলে ‘হিন্দু’ শব্দের উদ্ভব, যার মানে সিন্ধু নদীর এপাশে যারা বাস করে তাদের নাম। ঔপনিবেশিক আমলে ইংরেজ যখন লোকগণনা করছিল, তখন তারা ‘মোহামেডান’ চিনত, কিন্তু ‘হিন্দু’ কী এটা জানত না। তাই ‘মোহামেডান’ ছাড়া বাকি সবাইকে তাদের পরিসংখ্যানে ‘হিন্দু’ আখ্যা দিল।

অতএব জাতিবাদী হিন্দু বা হিন্দুত্ববাদ তার ঐতিহাসিক গড়ন ও চরিত্রের কারণেই মুসলমান বা ইসলাম নির্মূলের রাজনীতি করতে বাধ্য, কারণ এ ছাড়া তার নিজের সত্য প্রতিষ্ঠার আর কোন ভিত্তি নাই। হিন্দুত্ববাদের ‘হিন্দু’ একান্তই মুসলমানের বিপরীতে তৈরি একটি ধারণা মাত্র, তার অধিক কিছু নয়। আর সত্যকারের হিন্দু হচ্ছে সিন্ধু নদীর এপাশে বাস করা বিভিন্ন ও বিচিত্র ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনযাপন, জাতি ইত্যাদি বিপুল বৈচিত্র নিয়ে হাজির বিশাল এক জনগোষ্ঠি, এই সেই হিন্দুস্তান যেখানে মুসলমান তার ধর্মসহ অন্তর্ভূক্ত। মুঘল, পাঠান, ইরানি, তুরানি হিন্দুস্তানে এসে 'হিন্দুভূত' হয়েছে। মুসলমান অন্য দেশের অধীনে এই ভূগোল বা ভূখণ্ডকে পরাধীন করতে আসে নি, বরং এই দেশে বাস করতে এসেছে। তাই ‘হিন্দুস্তান’-এর জন্ম হয়েছে।  ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ভারত থেকে ইসলাম আরবে পারস্যে বা তুর্কিদের দেশে যাবার জন্য আসে নি। থাকবার জন্যই তার আসা।

এই হিন্দুত্ববাদ কি টিকবে? টিকবে যদি এর পাল্টা জবাব হয় মুসলমানদের জাতিবাদ বা ইসলামি জাতিবাদ। জাতিবাদী মুসলমানের ঝাণ্ডা উর্ধে তোলার অর্থ হিন্দু জাতিবাদের ন্যায্যতা প্রমাণ করা। যদি পালটা জবাব হয় সাম্প্রদায়িকতা, জাতিবাদ, শ্রেণী ও লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই,  জাত, শ্রেণি, লিঙ্গ সহ, সকল মজলুমের সঙ্গে একাত্মতা, সংহতি ও ঐক্যের চর্চা, তাহলে হিন্দু জাতীয়তাবাদ উপমহাদেশে টিকে থাকার যুক্তি খুঁজে পাবে না।

এই ঐক্য গড়ে উঠলেই হিন্দু জাতিবাদ ‘মুসলমান’কে খড়ের সৈনিক খাড়া করে তলোয়ার ও ত্রিশূল ঘুরাতে পারবে না। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশকেই পথ দেখাতে হবে।

৫.

বাদ পড়া বা পিছিয়ে পড়াদের বৃহত্তর 'বাঙালি' সমাজে অন্তর্ভূক্ত করে নেবার কঠিন কাজ বাদ দিয়ে মমতা ব্যানার্জি  ‘মুসলমান তোষন’-এর সোজা পথ নিয়েছিলেন। ফলে হিন্দু ও মুসলমান উভয়ই তাঁকে ভুল বুঝেছে। তাঁর হিজাব পরা মোনাজাত করা দেখে আমি বারবারই ভেবেছি, তিনি পশ্চিম বাংলার মুসলমানকে কেন শুধু ধর্মীয় পরিচয়ে পর্যবসিত করতে চান? তারা তো বাঙালিও বটে। এটা তাঁর জন্য যেমন বুমেরাং হবে একই ভাবে হিন্দু মুসলমান ভেদও বাড়বে, কমবে না। বরং দরকার ছিল সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়কে আরও বৃহত্তর পরিসরে অন্তর্ভূক্ত কিম্বা অঙ্গীভূত করে নেবার জন্য নিরলস কাজ করে যাওয়া। ‘বাঙালি’ কথাটার উচ্চবর্ণীয়, জাতিবাদি এবং সংকীর্ণ অর্থ পরিহার করে ভাষা ও সংস্কৃতিকে সকল ধর্ম, আদর্শ, ভাবচর্চার মাধ্যম বা ক্ষেত্রে পরিণত করা। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ রচনার ক্ষেত্র হচ্ছে ভাষা এবং সংস্কৃতি, যার মধ্যে দৈনন্দিনের জীবন যাপনও অন্তর্ভূক্ত। সেখানে সামাজিকীকীকরণ Socialisation) দ্রুত ও মজবুত হলে অপরাপর ভেদবুদ্ধি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না। দরকার ছিল,বর্তমানে নানান ধর্ম সম্প্রদায় এবং ইতিহাসের তিক্ত অভিজ্ঞতায় বিভক্ত ’বাঙালি’কে চুড়ান্ত সত্য জ্ঞান না করে একটি ঐতিহাসিক সম্ভাবনা হিশাবে বিবেচনা করা। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের একটি চরিত্রের মতো বলতে পারি,‘বাঙালি’ এখন যা তা না, বরং ‘বাঙালি’ আগামিতে কী হবে বা হতে পারে তার রূপ কল্পনা করতে শেখা।

বিজেপি সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও বিদ্বেষের জায়গা থেকে মমতা ব্যানার্জির বিরুদ্ধে  ‘মুসলমান তোষণ’-এর অভিযোগ তোলে। সদর্থে যারা মমতা ব্যানার্জির মুসলমান তোষণের সমালোচনা করেন তারা জোর দিয়ে থাকেন বাদ পড়া বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির উন্নয়নের ওপর। অর্থাৎ ‘তোষণ’ নয়, দরকার উন্নয়ন। হক কথা।

বিজেপি মার্কা তোষণের অভিযোগ আমরা তুলি না, তুলছি না, বরং বাদ পড়া বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠিকে বৃহত্তর সমাজে অন্তর্ভূক্ত করে নেবার রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের দিকেই আমরা নজর দিতে চাই। সম্প্রতি অমর্ত্য সেনের প্রতীচি ইন্সটিটিউট এবং Social Network for Assistance to People-এর  যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত ‘Living Reality of Muslims in West Bengal’ শিরোনামের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে পশ্চিম বাংলার সমাজ থেকে বাদ পড়ে যাওয়া বা পিছিয়ে পড়া মুসলমান জনগোষ্ঠির দুর্দশা ছবি খুবই করুণ। ফেইসবুকে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক দুই একটি পয়েন্ট ধরিয়ে দিতে চাইছি।

পশ্চিম বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় হুগলি ও হাওড়ায় নির্বাচনে তৃণমূল ভাল করেছে। এর কারণ হচ্ছে এখানে মুসলমানদের অবস্থা তুলনামূলক ভাবে ভাল। কিন্তু উত্তর দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, পুরুলিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে তৃণমূল খারাপ করেছে, এখানে মুসলমান জনগোষ্ঠি দারিদ্য সীমার নীচে বাস করে। মমতা ব্যানার্জি যদি স্রেফ ভোটের স্বার্থই দেখে থাকেন তাহলে মোনাজাত করা হিজাব পরা ইত্যাদির তো প্রয়োজন ছিল না; দরকার ছিল বাদ পড়া বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির অর্থনৈতিক উন্নতি। এরপর দরকার বাঙালির সংস্কৃতিতে ইসলাম ও বাঙালি মুসলমানের অবদান ও ভূমিকার স্বীকৃতি এবং বৃহৎ ও শক্তিশালী বাঙালি সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা। যেন সকল প্রকার সেকুলার এবং ধর্মীয় জাতিবাদকে পরাস্ত করা যায়। বাঙালির অপার সম্ভাবনা বৃহতের মধ্যে, খণ্ড খণ্ড টুকরা টাকরা হয়ে থাকার মধ্যে নয়। বিস্ময় যে বাঙালি পাশ্চাত্য অর্থে ধর্ম বা দ্বীনের বিপরীতে সেকুলার কিম্বা (বুর্জোয়া)মানবতাবাদের কথা বলে না, এটা তার ধারা না।অথচ বিস্ময় যে মানুষের অপার সম্ভাবনা ও আগামির কথা ভেবে বাঙালি ‘মানুষ ভজনা’র কথা বলে।অন্য কোন ভাষায় ‘মানুষ ভজনা’ কথাটার অনুবাদ হয় না।

তোষণ ও উন্নয়নের তর্ক কেন্দ্র করে পশ্চিম বাংলার সমাজ গবেষক শাহনেওয়াজ আলী রায়হান একটি দারুণ প্রশ্ন তুলেছেন। ‘সংখ্যালঘুর শুধু তোষণই প্রাপ্য?’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।  তিনি এখন বিলেতে পিএইচডি শেষ করছেন।  তাঁর এই নিবন্ধে তিনি জানাচ্ছেন, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৭ অবধি সরকারি চাকুরিতে মুসলমান ছিল ৭ শতাংশ, বাম আমলে সেটা এসে দাঁড়িয়েছিল ২ শতাংশে। মমতা যখন ক্ষমতায় এলেন তখন পুলিশে লোক নেওয়া হয়েছিল। চাকুরি পাওয়া ৪০০ জনের মধ্যে মাত্র ২১ জন ছিল মুসলমান। ২৫৫ জনকে রাজ্য সরকারের লোয়ার ডিভিশন ক্লার্কের চাকুরি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তার মধ্যে মুসলমান ছিল মাত্র ৫ জন। পঞ্চায়েত ভোটের আগে কনেষ্টবল নেওয়া হয়েছিল, সেখানে ২৩৫৪ জনের মধ্যে ৪৪৫ জন মাত্র ছিলেন মুসলমান, ইত্যাদি। যাঁরা আরও পড়তে চান তারা তাঁর ‘নিখোঁজ বসন্ত’ বইটি পড়ে দেখতে পারেন।

সাচার কমিটি রিপোর্ট বেরিয়েছে অনেক দিন হোল। তৃণমূলও ক্ষমতায় আছে অনেক দিন। কিন্তু মুসলমানদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় নি। সাচার কমিটি রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছিল বাদ পড়ে যাওয়া মুসলমান জনগোষ্ঠিকে পশ্চিম বাংলার সমাজে কার্যকর ভাবে অন্তর্ভূক্ত করে নেওয়া। কিন্তু মমতা সিপিএমের ভুলই অব্যাহত রাখলেন, বাদ পড়া জনগোষ্ঠিকে অন্তর্ভূক্ত করে নেবার কাজ থুয়ে তিনি মুসলমানদের বড় বড় জনসভায়  যেতে শুরু করলেন, হিজাব পড়তে আরম্ভ করলেন। মুসলমান ভোটারদের সভায় মোনাজাত করলেন, এমনকি নামাজও নাকি পড়েছেন! অথচ এসব কিছুরই দরকার ছিল না। ইসলাম ধর্ম তাঁর কাছে আকর্ষণীয় মনে হলে তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেই পারেন, সেটাই সবচেয়ে ভাল হোত। কিন্তু বঙ্গে সনাতন ধর্মের বৈচিত্র ও মহিমাও তো কোন অংশে কম না। বাদ পড়ে যাওয়া মুসলমান জনগোষ্ঠিকে বাঙালির বৃহত্তর সমাজে অন্তর্ভূক্ত করবার জন্য দরকার ছিল আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নীতি, যাতে একদিকে মুসলমান সমাজ তাদের অর্থনৈতিক পশ্চাতপদতা, বঞ্চনা এবং শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া অবস্থা থেকে দ্রুত মুক্তি পেতে পারে, যেন ধর্ম নির্বিশেষে সব্বাইকে নিয়ে একটা বৃহত্তর বাঙালি সমাজ তৈরির প্রক্রিয়ায় মুসলমান জনগোষ্ঠির অন্তর্ভূক্তি সহজ হয়। কিন্তু তিনি সেটা করলেন না। মুসলমানকে  ‘মুসলমান’ ছাড়া মমতা ব্যানার্জি আর কিছু ভাবতে পারলেন না। কেন তাঁর ধারণা হোল যে হিজাব বা মোনাজাত না করলে বাঙালি মুসলমান তাঁকে স্রেফ বাঙালি হিশাবে গ্রহণ করবে না? কেন তার মনে হোল মুসলমানদের জনসভায় তিনি হিজাব না পরে গেলে তাকে পশ্চিম বাংলার উর্দুভাষী নাগরিকরা মেনে নেবেন না? এটাই কি তাহলে সকল ধর্ম গোষ্ঠির প্রতি সমান আচরণ? এর জন্যই তিনি হিজাব, নামাজ, মোনাজাত দিয়ে তাদের ভোট পাওয়া নিশ্চিত করবার চেষ্টাটাই করলেন।

বিহার বা ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে যেসব মুসলমান পশ্চিম বাংলায় এসেছে ও স্থায়ী ভাবে বাস করছে তাদেরকে বাংলা সংস্কৃতির উদারপরিমণ্ডলে অন্তর্ভূক্ত এবং সেই সংস্কৃতিতে সাবলীল ভাবে অংশগ্রহণের কোন ব্যবস্থাও মমতা নিলেন না। পশ্চিম বাংলায় বৃহত্তর কোন সামাজিক পরিসর গড়ে উঠল না। যার যার ঘেট্টো, বসত বা বস্তি শহরের বিভিন্ন স্থানে পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেঁড়ে রইল। মমতা ব্যানার্জি প্রমাণ করবার কোন চেষ্টাই করলেন না যে কলকাতা ‘বাঙালির শহর’; কিন্তু এই অর্থে যে এই শহরের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি যেমন সকল ভাষাভাষিদের দিতে জানে তেমনি হিন্দি, উর্দু, উড়িয়া, অহম, মণিপুরি বা যে কোন সংস্কৃতি থেকে গ্রহণ করতেও কসুর করে না।

আমরা বাংলাদেশ থেকে কলকাতার সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা যখন দেখি তখন এটা ভেবে অবাক হই যে একটি মেট্রোপলিটান শহর হবার পরেও কলকাতার সাহিত্য ভাষার বিশেষ কোন বিবর্তন হয় নি। প্রাচীন অনড়তা এবং স্থবিরতা ভর করেছে যেখানে মেট্রোপলিটান শহরের কোন আলোড়ন কিম্বা ভাঙন নাই। অথচ যা একদমই হবার কথা ছিল না। পশ্চিম বাঙলায় ভাষা ও সংস্কৃতিতে বাঙালি মুসলমানের সক্রিয় ভূমিকা রাখবার কোন জায়গা আজও তৈরি হোল না। পশ্চিম বাংলার ভাষা এখনও সংস্কৃত ও তৎসম শব্দে আকীর্ণ উচ্চ বর্ণের হিন্দুর ভাষা রয়ে গিয়েছে। অথচ দরকার ছিল বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে বাঙালি মুসলমানের উপস্থিতি দৃঢ় করা। ভাষা ও সংস্কৃতির প্রশ্নে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিশাবে কায়েম হবার পরও পশ্চিম বাংলা আজও  বাংলা ভাষায় আরবি ও ফারসি দেখে আঁতকে ওঠে।

তৃণমূল কংগ্রেস সিপিএমকে হঠিয়ে ক্ষমতায় আসে ২০১১ সালে। পশ্চিম বাংলায় সিপিএমের ৩৪ বছরের শাসন উলটে যাওয়া ছিল ভারতের রাজনীতির তাৎপর্যপূর্ণ বাঁক। প্রশ্ন উঠেছে, এতো বছর ক্ষমতায় থাকার পরও পশ্চিম বাংলার মার্কস, মার্কসবাদ কিম্বা নানান কিসিমের বামপন্থা  বাঙালি হিন্দুর ধর্ম পর্যালোচনার কাজকে ফেলে রেখে একাট্টা দর্মের বিরোধিতা করল কেন? ধর্মকে সংবিধান বা আইন দিয়ে মোকাবিলা না করে বুদ্ধিবৃত্তিক বা সাংস্কৃতিক ভাবে মোকাবিলার কোন দৃশ্যমান চেষ্টা কই? এখন হিন্দু ধর্মের বিশেষ উত্তর ভারতীয় রূপ যেভাবে জাতিবাদি হিন্দুর রাজনৈতিক আত্মপরিচয় নির্ণয়ে নির্ধারক ভূমিকা রেখেছে তার জন্য পশ্চিম বাংলার বুদ্ধিজীবি ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের দায় আছে।  ধর্ম পর্যালোচনার কাজ বাদ দিয়ে পশ্চিম বাংলায় আমরা বাংলাদেশে মতোই একাট্টা ধর্মের বিরোধিতা দেখি, অথচ ধর্ম বিদ্বেষকেই মার্কসবাদ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। ধর্মের ঐতিহাসিক কিম্বা দার্শনিক পর্যালোচনার কোন নজির পশ্চিম বাংলার বুদ্ধিজীবি বা সাংস্কৃতিক মহলে আমরা দেখি না। অথচ মার্কসই বলেছিলেন অন্য সকল বিষয়ের পর্যালোচনার আগে দরকার ধর্মের পর্যালোচনা। এই পর্যালোচনাই রাজনীতি, রাষ্ট্র ও গণমানুষের চিন্তাচেতনা বিচারের শর্ত তৈরি করে। ধর্ম বা সংস্কৃতিকে গুরুত্বপূর্ণ গ্ণ্য না করার পেছনে বামপন্থার অনুমান হচ্ছে অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটানো গেলেই ধর্ম প্রশ্নের  মীমাংসা আপনা আপনি হয়ে যাবে। ব্যতিক্রম আছে কিনা জানি না, তবে সীমান্তের এদিক থেকে মনে হয় সেকুলারিজম বলতে পশ্চিম বাংলার বামপন্থা একাট্টা ধর্ম বিরোধিতাই বুঝেছে? কিম্বা বুঝেছে সকল ধর্মের প্রতি সমান আচরণ? অর্থাৎ যার যার ধর্ম যার যার মতো থাকুক, সেকুলার কর্তব্য হোল সকলের প্রতি সমান আচরণ করা। সকল ধর্মের প্রতি সমান আচরণ – মমতা ব্যানার্জি সেটাই করেছেন, যাকে এখন ‘মুসলমান তোষণ’ বলা হচ্ছে। মূল কাজ ফেলে রেখে ভোটের জন্য একটি ধর্ম সম্প্রদায় তোষণের পরিণতি কী হতে পারে সেটা কিছুটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাবার কথা।

সিপিএমের ধর্মের প্রশ্ন মোকাবিলার ব্যর্থতা তৃণমূলের দিকে জন সমর্থন ঝুঁকে যাবার কারন হয়েছে। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি এই ঝোঁকের মর্ম ধরতে পারেন নি। সেই ঝোঁকই এখন আরও পরিণত হয়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদী বা নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্ববাদের রূপ নিয়েছে। এই পরিণতির হয়তো আরও অনেক কারন থাকতে পারে। পশ্চিম বাংলার গণমানসকে বোঝার জন্য হয়তো আরও অনেক গবেষণা দরকার।

তবে দুটো বিষয় আমরা উল্লেখ করতে চাই। প্রথমে নন্দীগ্রামের ঘটনা এবং নন্দীগ্রাম কেন্দ্র করে মুসলমান জনগোষ্ঠির প্রতিক্রিয়া। সিপিএম থেকে পশ্চিম বাংলার মুসলমান মুখ ফিরিয়ে নেবার ক্ষেত্রে নন্দীগ্রাম ভূমিকা রেখেছে। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে সাচার কমিটি রিপোর্ট। ভারতের সাবেক প্রধান মন্ত্রী মনোমোহন সিং  ২০০৫ সালের মার্চে দিল্লি আদালতের প্রধান বিচারপতি রাজেন্দর সাচারকে প্রধান করে সাত জনের একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেন। তাঁদের কাজ ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং শিক্ষা্র ক্ষেত্রে ভারতীয় মুসলমানদের অবস্থা জানানো। সাচার কমিটি রিপোর্ট সবার পাঠের জন্য উন্মুক্ত করা হয় ২০০৬ সালের ৩০ নভেম্বর। এই রিপোর্ট ভারতীয় সমাজ, প্রশাসন ও রাজনীতিতে মুসলমান জনগোষ্ঠির প্রশ্নকে নতুন মাত্রা দান করে। সাচার কমিটি রিপোর্টে মুসলমান জনগোষ্ঠির দুর্দশা এবং সমাজের পেছনে পড়ে থাকা নিয়ে তুমুল আলোচনা ও তর্ক শুরু হয়। পরিষ্কার হয়ে যায়, সিপিএমের আমলেও পশ্চিম বাংলায় হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা হয় নি বটে, কিন্তু শিক্ষা, সামাজিক অবস্থা এবং সরকারি চাকরিবাকরির ক্ষেত্রে মুসলমান সমাজ মারাত্মক ভাবে বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে, সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়েছে। সোজা কথায় পশ্চিম বাংলার সমাজ থেকে মুসলমান জনগোষ্ঠি একদমই বাদ পড়ে গিয়েছে। বাদ পড়ে যাওয়াদের সমাজে অন্তর্ভূক্ত করা এবং তাদের প্রতি নাগরিক সমতা ও সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করবার কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নি।

সাচার কমিটি রিপোর্ট মুসলমানদের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনায় বদল ঘটিয়েছে, তারা উন্নতি চায়, চাকরি চায়, জীবিকার নিশ্চয়তা চায়, অর্থনৈতিক সচ্ছলতা চায়, ইত্যাদি। তৃণমূলের কাছ থেকে তারা মসজিদের ইমামদের জন্য ভাতা  পেয়েছে, কিন্তু আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নিশ্চয়তা পায় নি। 

অথচা মমতা দাবি করেছেন উন্নয়নের নিরানব্বই ভাগই তিনি নাকি করে ফেলেছেন!

Comments

Popular posts from this blog

ডিসি বা ডেপুটি কমিশনার কেন জেলা প্রশাসক - ড. আমিন

মূর্তি ও ভাস্কর্য - ডঃ আমিন

আইনস্টাইনের পাঁচ বাড়ির ধাঁধা: মৎস্যাধারের মাছ চুরি করেছে কে?