ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা
আমার গ্রামে একটা প্রবাদ আছে, 'ছাল নাই কুকুর, তাঁর আবার বাগার বেশি।' এই বেটার ভিডিওটা দেখতে দেখতে সেই ছালহীন কুকুরের কথা মনে পরে গেলো। তিনি তাঁর ভিডিওটিতে প্রশ্ন করে বলেছেন, পৃথিবীতে এমন একটি দেশ আছে যে দেশের নাগরিক না অথচ তাঁর লেখা সংগীত জাতীয় সংগীত হিসেবে ব্যবহার হয়? ভাবখানা এমন যে সে নিজে মহা এক জ্ঞানী, আর তাঁর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সাধ্য পৃথিবীতে কারো নাই। তো এই মহা মূর্খ পন্ডিত জানেই না, কেবল ভারত এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতই নয়, শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতটিও ঐ রবীন্দ্রনাথেরই লেখা।
এই গাধা তো কোনদিন জাতীয় সংগীত গেয়ে দেখে নাই। পড়েও দেখে নাই। না হলে রবীন্দ্রনাথের অন্য একটি গানের লাইন আমাদের জাতীয় সংগীতের ভেতর কেমনে ঢুকিয়ে দেয়?
'ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা'
নিশ্চয় এই গানটা অনেকেই জানেন, তো এই গানের অংশ 'তোমার পরে ঠেকাই মাথা' এটা আমাদের জাতীয় সংগীতে কিভাবে ঢুকলো? পরের জায়গায় আবার তরেকেও ডেকে আনলেন, কি আজিব! আসলে সেটা নয়। আমাদের জাতীয় সংগীতটি রবীন্দ্রনাথের একটি দীর্ঘ কবিতা যার মাত্র দশ লাইন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ব্যবহার হয়। সেখানে এমন কোন অংশ নাই। লাইনটি উপরের ঐ গানেরই অংশ। তবে আমাদের জাতীয় সংগীতের দীর্ঘ এই কবিতাটির অনেক নিচের দিকে একটি লাইন আছে যেখানে বলা হচ্ছে 'ও মা, তোর চরণেতে দিলেম এই মাথা পেতে।' বেটা সেখানেই সব তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। এই অংশটা আমাদের জাতীয় সংগীতে গাওয়াও হয় না।
রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের জন্য কিছুই করেন নাই? আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস কি এই লোক কখনো পড়ে দেখেছে? পুরো মুক্তিসংগ্রামের সময়টাতেই আমাদের উজ্জীবিত করেছিল রবীন্দ্রনাথের গান ও তাঁর কবিতা। রবীন্দ্রনাথের রচনার মধ্য দিয়েই বাঙালীর আত্ম-আবিষ্কার সূচিত হয়েছিল, ভিত্তি হয়ে উঠেছিল এক রাজনৈতিক আন্দোলনের। ১৯৬১ সালে পাকিস্তানী শাসকেরা বাধ্য হয়েছিল এই দেশে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতাকে নিষিদ্ধ করতে। কিন্তু বাঙালিরা যেন আরো বেশি করে তাকে আকড়ে ধরলো। সেই সময় রবীন্দ্রনাথকে আকড়ে ধরেই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য গড়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথই হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের সংস্কৃতীর প্রতীক। সে যাই হোক এই মাথামোটা এগুলো বুঝবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে এই রবীন্দ্রনাথ নাকি একমাত্র ব্যক্তি যিনি ভেটো প্রদান করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টি ঢাকায় না করে কলকাতায় করতে। কি মনগড়া ও হাস্যকর অভিযোগ! এটা সত্য যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে আপত্তি উঠেছিল। তবে সেই আপত্তি যেমন কোন এক ব্যক্তি করেনি, তেমনি এই আপত্তির সাথে রবীন্দ্রনাথেরও কোন সংশ্লিষ্ঠতা নাই। আপত্তি যেমন উঠেছিল কলকাতার কিছু হিন্দু সংগঠনের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে, তেমনি কলকাতার ধনীক মুসলমান সম্প্রদায়ের কাছ থেকেও আপত্তি এসেছে। আপত্তি উঠেছে পূর্ব বাংলা তথা বর্তমান বাংলাদেশের মুসলমান কিছু রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যাক্তিবর্গের কাছ থেকেও।
মওলানা আকরাম খান, আবদুর রসুল, এমনকি চব্বিশ পরগনার জেলা মহামেডান (মুসলিম ফুটবল দলরে ভাই) এসোসিয়েশন পর্যন্ত আপত্তি জানিয়েছে। কিন্তু যে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর অভিযোগ সেই তিনিই এদের ধারে কাছেও তখন নাই। আসলে এমন একটি ভিত্তিহীন অভিযোগ প্রথম ইসলামি ফাউন্ডেশন কতৃক প্রকাশিত একটি বইয়ে করা হয়। যেখানে এর সত্যতার যাচাই করা হয়নি। কোন সূত্র থেকে তাঁদের এই দাবী তারও উল্লেখ করা হয়নি। কেবল অভিযোগ করেই সাড়া। উদ্যেশ্য যে তাঁদের ভালো ছিল না সেটা বোঝা যায় এর পক্ষে কোন দলিল উপস্থাপন না করাতেই। এর কিছু পরে মেজর জেনারেল আব্দুল মতিন একই অভিযোগ করেন। এবং তিনি যে বইয়ের রেফারেন্স দিলেন সেটা হল সেই ইসলামিক ফাউন্ডেশন কতৃক প্রকাশিত বইটির যে বইটিও এর কোন সত্যতা নিশ্চিত করতে পারে নাই।
অভিযোগটি ছিল এমন ‘১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলিকাতা গড়ের মাঠে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়।’ মজার বিষয় হল এই তারিখে রবীন্দ্রনাথ কলকাতাতেই ছিলেন না। তিনি ছিলেন শিলাইদহে। ১৯ মার্চ তাঁর ইংল্যান্ড যাবার কথা ছিল। কিন্তু অসুস্থতার কারণে আর যাওয়া হয়ে উঠেনি।
তিনি ২১ মার্চ ১৯১২ (৮ চৈত্র ১৩১৮ বঙ্গাব্দ) তারিখে ডাঃ দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রকে লেখেন—‘আমার কপাল মন্দ—কপালের ভিতরে যে পদার্থ আছে, তারও গলদ আছে—নইলে ঠিক জাহাজে ওঠবার মুহুর্তেই মাথা ঘুরে পড়লুম কেন? অনেক দিনের সঞ্চিত পাপের দণ্ড সেইদিনই প্রত্যুষে আমার একেবারে মাথার উপরে এসে পড়ল। রোগের প্রথম ধাক্কাটা তো একরকম কেটে গেছে। এখন ডাক্তারের উৎপাতে প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। লেখাপড়া নড়াচড়া প্রভৃতি সজীব প্রাণীমাত্রেরই অধিকার আছে, আমার পক্ষে তা একেবারে নিষিদ্ধ।…’
২৪ মার্চ ১৯১২ (১১ চৈত্র ১৩১৮ বঙ্গাব্দ) বিশ্রামের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে রওনা হন। ঠাকুরবাড়ির ক্যাশবহিতে লেখা আছে, শ্রীযুক্ত রবীন্দ্র বাবু মহাশয় ও শ্রীযুক্ত রথীন্দ্র বাবু মহাশয় ও শ্রীমতি বধুমাতাঠাকুরাণী সিলাইদহ গমনের ব্যায় ৩৭৯ নং ভাউচার ১১ চৈত্র ১৫।।৩।. পরদিন সোমবার ১২ চৈত্র ২৫ মার্চ ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ মৌচাক পত্রিকার সম্পাদক সুধীরচন্দ্র সরকারের ভগ্নী কাদম্বিনী দত্তকে (১২৮৫—১৩৫০ বঙ্গাব্দ) এক চিঠিতে লেখেন—এখনো মাথার পরিশ্রম নিষেধ। শিলাইদহে নির্জ্জনে পালাইয়া আসিয়াছি।
১৯১২ সালের ২৮ শে মার্চ রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠি লিখেছেন জগদানন্দ রায়কে। জগদানন্দ রায় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক, রবীন্দ্রনাথের পুত্রকন্যাদের গৃহশিক্ষক ও শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের শিক্ষক। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। চৈত্র ১৫, ১৩১৮ বঙ্গাব্দ। রবীন্দ্রনাথ চিঠিটি লিখেছেন শিলাইদহ থেকে। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন—‘কয়দিন এখানে এসে সুস্থ বোধ করছিলুম। মনে করেছিলুম সেদিন যে ধাক্কাটা খেয়েছিলুম সেটা কিছুই নয়। সুস্থ হয়ে উঠলেই অসুখটাকে মিথ্যা বলে মনে হয়। আবার আজ দেখি সকাল বেলায় মাথাটা রীতিমত টলমল করচে। কাল বুধবার ছিল বলে, কাল সন্ধ্যাবেলায় মেয়েদের নিয়ে একটু আলোচনা করছিলুম—এইটুকুতেই আমার মাথা যখন কাবু হয়ে পড়ল তখন বুঝতে পারচি নিতান্ত উড়িয়ে দিলে চলবে না।’ (বি, ভা. প, মাঘ-চৈত্র ১৩৭৬। ২৫৩, পত্র৫)।
প্রশান্তকুমার পাল রবিজীবনী গ্রন্থের ষষ্ঠ খণ্ডে জানাচ্ছেন, এদিনই তিনি একটি কবিতা লেখেন। কবিতার নাম—‘ স্থির নয়নে তাকিয়ে আছি’। এই কবিতাটি গীতিমাল্য কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ৪ সংখ্যক কবিতা। এর পর বাকী ১৫ দিনে শিলাইদহে থেকে রবীন্দ্রনাথ আরও ১৭টি কবিতা বা গান লেখেন। এর মধ্যে একটি গান—আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ। ১৪ চৈত্র, ১৩১৮ বঙ্গাব্দ। রচনার স্থান শিলাইদহ। ২৬শে চৈত্র ১৩১৮(এপ্রিল ৮, ১৯১২) বঙ্গাব্দেও তিনি শিলাইদহে। সেখান থেকে লিখেছেন—এবার আমায় ভাসিয়ে দিতে হবে আমার। এপ্রিল ১২, ১৯১২ তারিখে লিখছেন—এবার তোরা আমার যাবার বেলাতে। শিলাইদহে রচিত। ঐ ১২ এপ্রিল, ১৯১২ শিলাইদহ থেকে তিনি কোলকাতায় রওনা হন। (তথ্যসূত্রঃ কুলদা রায়, ৯ ডিসেম্বর ২০১১, বিডিনিউজ২৪.কম)
এতো প্রমাণ হাজির করার পরেও ছোট্ট একখান প্রশ্ন করি ভাইসাব। আপনার কথায়, যদি রবীন্দ্রনাথ ভেটো দিয়েই থাকতেন তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় কেন তাকে এখানে বক্তৃতা করার জন্য আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসা হয়েছিল? কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তখন তাঁর প্রতিবাদ করে নাই? কেন ১৯৩৬ সালে তাকে ডিলিট উপাধী প্রদানের বিষয়েও বিরোধিতা হয় নাই? নাকি তখনকার ছাত্র সমাজ আপনার মতো জ্ঞানী ছিল না?
আসলে সমস্যা এটা নয়। এটা আপনার মুসলিম মানসিকতায় গড়ে ওঠা চিরাচরিত হিন্দু বিদ্ধেষ। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, আপনি বেটা এটাও জানে না যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোন হিন্দু ছিলেন না।
ক্রেডিটঃ Md Amir Hossain
Comments
Post a Comment